আমার দীর্ঘ শিক্ষকতা পেশায় অনেক ধরনের ছাত্রী পেয়েছি,কেউ ভিষন দুষ্টু, কেউ পড়ালেখায় খুব সিরিয়াস, আবার কোন ছাত্রী কেন পড়তে এসেছে সেটা নিয়ে কনফিউজ। আপাত দৃষ্টিতে এই রকম এক কনফিউজ ছাত্রীকে নিয়ে আমার আজকের লেখা….
পাঁচ তলার ক্লাস নিয়ে মাত্র টিচার্স রুমে এসে বসেছি, হঠাৎ ওই ক্লাসের সামনের বারান্দায় খুব চিতকার চেচামেচি, পুরো বারান্দাতেই ছাত্রীরা দৌড়াদৌড়ি করছে,আমরা জানালা দিয়ে দেখে তাড়াতাড়ি ডিসিপ্লিন শিক্ষক কে পাঠালাম, সাথে একজন আয়া, ধারণা করছি, গরমে কোন মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে, যেহেতু আমি মাত্র ক্লাস নিয়ে আসলাম তাই আমিও ওদের পিছন পিছন গেলাম। যা দেখলাম তা যথেষ্ট অস্বাভাবিক!!
আমার সেই কেন পড়তে এসেছে ধরনের কনফিউজড ছাত্রীটিকে দেখলাম চারজন অন্য ছাত্রী, আর ক্লাস ক্যাপ্টেন মিলে ধরে রেখেছে, ওরা বিদ্ধস্ত, এমনকি এই ধস্তাধস্তিতে কারো চুল খুলে গেছে, ক্রস বেল্ট ওড়না এলোমেলো আর যার জন্যে ওদের এই দশা, তার অবস্থা আরো ভয়াবহ, দৃষ্টি ভাবলেশহীন, অসম্ভব শক্তি দিয়ে সে অন্যদের হাত থেকে ছাড়া পাবার চেষ্টা করছে,হালকা পাতলা মেয়েটিকে যেন কোন আসুরিক শক্তি ভর করেছে। মেয়েরা আমাকে দেখে সবাই একসাথে বলার চেষ্টা করছে যে মেয়েটি পাঁচ তলা থেকে জাম্প করতে যাচ্ছিল, আমি কথাটা শুনেও ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনা সত্যি ঘটনাটা কি,এরই মধ্যে মেয়েটি একটা বিশ্রী গালি দিল ওদেরকে বেশ জোরে,ততক্ষনে আমরা দুইতলার ল্যান্ডিং এ এসে গেছি আমি ওর গালাগালি শুনে ডিসিপ্লিন টিচারের দিকে তাকালাম ও জোরে বললো এক থাপ্পড় দিব,বাজে কথা বললে,ওর কথা শেষ হয়নি মেয়েটি টিচারের দিকে এগিয়ে গেল মারার জন্যে,আমি মেয়েটিকে বেশ জোরেই একটা থাপ্পড় দিলাম, অদ্ভুত ব্যাপার মেয়েটি একদম থেমে গেল, একদম শান্ত হয়ে আমার শাড়ির আঁচল হাতে জড়িয়ে ধরলো, আমি ওকে নিয়ে ডিসিপ্লিন টিচার আর আয়া সহ নেমে এলাম উপাধ্যক্ষ এর রুমে।
মেয়েটি অসম্ভব ঘামছে, ফ্যান, এসি কোন কিছুতেই ওর অস্বাভাবিকতা যাচ্ছে না,রুম থেকে সবাইকে বের করে আমি আর ডিসিপ্লিন শিক্ষক ওকে কোল্ড ড্রিংকস আর বিস্কুট দিলাম খেতে,ও খাচ্ছেনা, বরং আমার যতখানি কোলের কাছাকাছি আসা যায় চলে আসছে, আমার পুরো আঁচল দিয়ে নিজেকে জড়িয়ে নিচ্ছে। বুঝাই যাচ্ছে মেয়েটি অদৃশ্য কিছুর ভয়ে ভীত।
আমরা মেয়েটিকে একটু স্বাভাবিক করার জন্যে ওর সাথে গল্প করা শুরু করলাম, আমি যত কথাই বলি ও শুধু হাসে,সে হাসিতে কোন উচ্ছ্বাস নেই,এই ফাঁকে ওর অভিভাবকের সাথে ফোনে কথা বলে তাদের আসতে বলা হল! প্রায় ঘন্টা দুয়েক পরে ছাত্রীটির মা আর ওর বড় ভাই এলেন,আমরা চেয়েছিলাম বাবা মা দুজনেই আসুক কিন্তু ভাইটি জানাল, গদী ছাইড়া এখন বাবায় পারবোনা আসতে,যা বলার আমারে বলেন…
মা মাথা নেড়ে সায় দিলেন, ভাই এর বয়স ২৩/২৪ হবে, সে খুবই বিরক্ত। মেয়েটি মা আর ভাইকে দেখে স্বস্তি পাওয়ার বদলে কেমন যেন আরো ভীত হয়ে পড়ল।
আমি ছাত্রীটিকে ডিসিপ্লিন শিক্ষক এর কাছে রেখে মার সাথে কথা বলতে চাইলাম একা, কারন অভিভাবক এর স্থানে ভাইয়ের নাম নেই, কিন্তু মা ছেলেকে ছাড়া কথা বলবেন না, দুজনের সামনে কোন উত্তেজনা প্রকাশ না করে জানালাম সকালের ঘটনা, আর ওর অন্যমনস্ক থাকা, ক্লাসে অমনোযোগী থাকা ইত্যাদি, আসলে আমি চাইছিলাম জানতে তার বাসায় কোন সমস্যা কিনা?
কোন উত্তরই মা দিলেন না, ভাইটি বললো বাসায় কোন সমস্যা নাই, চাওয়ার আগেই তাকে সব দেয়া হয়, চাইরটা মাষ্টার আইসা বাড়িতে পড়ায় আর কি লাগে?
এর মাঝে মিনমিন করে মা কিছু বলতে গেলেন, ছেলেটি এক ধমক দিল মাকে, তুমি থামো!!
আমি এবার নড়েচড়ে বসলাম,ভাইকে অগ্রাহ্য করে মাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম ওর সাথে কোন অস্বাভাবিক ঘটনা নিশ্চয়ই ঘটেছে,আপনি বলেন। ভাইটি খুব জোরে প্রতিবাদ করলো, আমার বইনে অনেক বানায় কথা বলে, সারাদিন মোবাইল টিপলে এমনই হয়। খুব আস্তে মায়ের মুখের কথা শুনলাম, সপ্তাহ তিনেক আগে ছাদে গেছিল বিকালে তখন খারাপ বাতাস লাগসে, সে থেইকা মাঝেমধ্যে চমকায় উঠে!!!
তারা মেয়েটিকে নিয়ে চলে গেলেন,প্রায় দিন পনেরো পর মেয়েটি কলেজে এলো, আমি ডেকে জিজ্ঞেস করলাম ভালো আছো,হ্যাঁ ম্যাডাম জ্বর হয়েছিল তাই আসিনি, আচ্ছা এখন রেগুলার ক্লাস করবে, চলে আসছি, মেয়েটিও আমার সাথে আসছে..
কিছু বলবে?
ম্যডাম আমার কোন বাতাস লাগেনি, সেদিন ছাদে আমি গেছিলাম, আমার চাচাতো ভাই, আমার গায়ে হাত দিসে, আমার মুখে.. বলে জোরে কাঁদতে শুরু করল।
আমি ওকে উপরে এনে কিছুটা শান্ত করলাম, ও বললো আমার ভাই, আম্মা আব্বা সবাইরে বলছি, কেউ বিশ্বাস করেনা, ভাই বলে আমি বানায়ে কথা বলি, আম্মা বলে এইসব কথা বলতে হয়না, যা হইসে ভুলে যা, আব্বা বলছে পড়া লেখা করার দরকার নাই। আমারতো নিজেরে ঘিন্না লাগে, আব্বা কাছে আসলেও ভয় লাগে। আমি কি করবো আপা?
আবারো অভিভাবক ডাকলাম, যথারীতি বাবা এলেননা, ভাই আর মা এলো, আমি সব খুলে বললাম, তাদের সহযোগিতা চাইলাম, প্রয়োজনে মনোচিকিৎসক দেখাতে বললাম, ভাইটি প্রচন্ড রেগে গেল, সামান্য বিষয়কে আপনারা জটিল করছেন, আমার বোন কে এই কলেজে পড়াব না, ওর কোনদিন বিয়ে হবে? এই সব পাগলের ডাক্তারের কাছে নিলে?
ছাত্রীটির মা আমার দু হাত ধরে বললেন, আমার মেয়ে আপনারে অনেক মানে, আপনি ওরে শুধু বলেন এইসব কথা বলতে হয়না, আপনিওতো মেয়ে মানুষ, বুঝেনতো।
ওর বিয়া ঠিক করসে ওর বাবায়, শুধু ওরে বলেন, এইসব কথা বলতে হয়না!!!!!
মেয়েটি আর কলেজে আসেনি। আমি জানিনা ও কি সুস্থ আছে? ঘর সংসার করছে, পড়াশোনা করছে নাকি যে জাম্প সে দিতে চেয়েছিল সেটে দিয়ে ফেলেছে??
আমি জানিনা, আমার এখন মনে হয় সেদিন আমার আরো শক্তভাবে বিষয়টা হ্যান্ডেল করা উচিৎ ছিল যা আমি করিনি অথবা পারিবেশ পরিস্থিতি আমাকে করতে দেয়নি।


Shabnaz Dithi (Mishty Haque) is a Merchandiser at Total Denim Solution. Her passion is drawing. She spends her time with pursuing her hobbies in reading books, taking photos, and cooking! The wonderful artwork in this article has been wonderfully drew by her.
প্রত্যেক বাবা-মা’র উচিৎ ছেলে-মেয়ের কথার গুরুত্ব দেয়া। খুব জানতে ইচ্ছা করছে মেয়েটি এখন কেমন আছে! বেঁচে আছে কিনা! ☹️
আমি যখন মা হবো, চেষ্টা করবো আমার সন্তানের কথার গুরুত্ব দেয়ার, তার বন্ধু হওয়ার, ইনশাআল্লাহ।
আমি কলেজে পড়াকালীন সময়ে এমন কয়েকজনের কথা ই শুনেছি মন খারাপ করেছি কিন্তু কিছু করতে পারিনি 😔
আমার মতে সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজের সবচেয়ে ভালোলাগার জায়গা আমাদের শিক্ষিকারা❤️, এতোটা বন্ধুসুলভ শিক্ষিকা কোথাও দেখিনি শুনিও নি😊
আপা,
আপনার অভিজ্ঞতা আসলেই নিদারুন। কত অসংখ্য মেয়ের জীবনের ঘটনা এটা সত্যিকারের তথ্য উপাত্তে আসেনা।
এই মেয়েগুলোর জীবনে কি ঘটে তারপর? কতটা বিষন্ন জীবন তার হয়?
আপা, women empowerment movement করে কি ফল পাচ্ছি আমরা? কথা বলা যায় না, যেমন আপনি লিখেছেন মুখ খোলা যায়না ছেলের সামনে। কথা বলতে পারেনা স্ত্রী, সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা মা…. মেয়েকে বাচানোর সিদ্ধান্তটাও নিতে পারে না…আহারে মা।
চাকরি করতে পারা আর উপার্জন করতে পারা এই পর্যন্ত আসতে পারাটাই অনেকের কাছে বিরাট অর্জন। সিদ্ধান্ত নিতে পারার অধিকার… সে আরেক অধ্যায় হবে।
আপা, আপনি তো জানেনই এ শুধু আমাদের দেশের চিত্র না, পৃথিবী জুড়েই এই কষ্ট। কদিন আগে একটা সিনেমা দেখলাম ” you can not take my daughter”… মেয়েটার কি মানসিক শক্তি এতো প্রতিকূলতার মধ্যেও।
আপা, আপনি কি এই platform এ মানসিক শক্তি যোগাবেন?
পরিবার, সমাজ, প্রশাসন সবাই বিমুখ।
আপনি, আমি, আমরা কতটুকু পারবো?
খুব ভালো লেগেছে আপনার এই প্রচেষ্ট।
ভালো থাকবেন আপা।
Shob baba ma’r uchit tader bacchader kotha shuna ar gurottoh dewa. Meye ta kemon ache akhon? Thik ache o? Beche ache?
আর কতো !!
সমাজ, পরিবেশ, পরিস্থিতি নামক কিছু অধ্যায়ের জন্য পুরো বই টি ই বন্ধ করে দিচ্ছে কিছু ভীত শ্রেণী! তারা জানে না বেঁচে থাকলে বাঁচার মতো করে বাঁচতে হবে। বেঁচে থেকে যেনো মনে না আসে আমি বেঁচে নেই। সেই বেঁচে থাকার কোনো মানেও নেই। কিন্তু আমরা দুর্বল ভীত। কিছু চ্যাপ্টার এর ভয়ে পুরো বই টা পড়তে সাহস পাই না 😔
এ জন্যে আমাদের দেশে স্কুল-কলেজে কাউন্সিলিং টা খুব জরুরী। সামান্য ভুলে কতো প্রান যে ঝরে যায়, তার খবর বা হিসাব কোথাও নেই।
https://www.facebook.com/Psychobd/