ডুংরি নামের ছোট্র আদিবাসী গ্রাম। প্রকৃতি তার অপার বৈভব দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে এই গ্রামটিকে।এখন সকাল।চারিদিকে ঝলমলে রোদ্দুর! ঝিরঝিরে হাওয়া যেন লুকোচুরি খেলছে রোদ্দুরের সাথে।আজ ছুটি। ডক্টর অনিন্দ্য চৌধুরী তার অতি সাধারন ছোট্ট আবাসে বসেরোগী দেখছে।ছুটির দিনে, সকালের এই সময় কিছু রোগী দেখে ।বিন্দিয়া ..সাত বছরের ভারি মিষ্টি মেয়েটি ঠান্ডা আর জ্বর নিয়ে এসেছে .. সাথে বাবা বাবু লাল। গ্রামের সবাইকেই অনিন্দ্য চেনে..বিন্দিয়াকেদেখলেই টুইয়ের কথা মনে পড়ে যায়…ওর মেয়ে।চেক করে চিন্তিত হলো,বুকে ঠান্ডা বসে গেছে..জ্বরওআছে..নিজের কাছে কিছু ঔষুধ রাখে সেখান থেকেঔষুধ দিয়ে দিলো…বলো দিলে সমস্যা হলে সাথে সাথেজানাতে।আরো কিছু রোগী দেখলো…এরপর উঠে পড়লো। ডুংরি গ্রামটি ভারি সুন্দর, পাহাড়ের কোল ঘেসেগড়ে উঠেছে।মিশনারি হাসপাতালটা এখান থেকে বেশ দুরে।যাতায়ত সমস্যা …তবু অনিন্দ্য এখানেই থাকে।এইতৃনমূল মানুষ গুলোর জন্য ওর গভীর মায়া।গ্রামটি অনুন্নত …তবে ওরা প্রচন্ড পরিশ্রমী ও কর্মঠ। জুম চাষের মাধ্যমে আনারস সহ বিভিন্ন তরি তরকারী ফলায়। কিছু মানুষ মোটা কাপড় বুনে কাছাকাছি হাটে বিক্রি করে।কষ্টের তুলনায় লাভ খুব কম পায়।
দেশের এই দুর্নীতি গ্রস্হ অর্থনৈতিক কাঠামোই এ জন্য দায়ী।অনিন্দ্যর প্রচন্ড রাগ হয় এই সিস্টেমের উপর..কিন্তু একা ও কি করবে! এ মানুষ গুলোর সাথে ওর একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
রবীন্দ্রনাথের কথায়, যে আত্মার কাছাকাছি থাকে সেই আত্মীয়।অনিন্দ্য এখানে সম্পূর্ণ একা…একাকিত্বের ভার বহন করা কঠিন।মাঝে মাঝে হতাশায় পেয়ে বসে..কিন্তু যখন এই মানুষ গুলোর কথা ভাবে..তাদের পাশে থাকার কথা ভাবে তখন আবার নতুন উদ্দিপনায় সামনে এগিয়ে যায়।
এর সাথে আছে এখনকার অপরুপ সুন্দর প্রকৃতি। এই অপুর্ব নৈসর্গিক দৃশ্যবলী মনকে তৃপ্ত করে দেয়।মনে দেয়অপার শান্তি… চারিদিকে কত যে পাখি ডাকে..দুরে পাহাড়ের ফাঁক গলে দেখা যায় সুনীল আঁকাশ… নীচে একেবেকে চলে গেছে নদী… যার নাম শাড়ী..কি মন কাঁড়া নাম! প্রকৃতিও কথা বলে..যে বোঝার সেই বোঝে…প্রকৃতি ওর বন্ধু হয়ে গেছে।অনিন্দ্যর এই প্রায় নির্বাসিত জীবনের একটা গল্প আছে। যেটা সে সযত্নে লুকিয়ে রাখে লোকচক্ষুর অন্তরালে!
ধনী পরিবারের সন্তান,কোন কিছুর অভাব দেখেনি! দুই ভাই এক বোন। সে ছোট। বাবা ব্যবসায়ী.. প্রচুর টাকা, অনিন্দ্য বড় হতে হতে বুঝে গিয়েছিল সবইকালো টাকা… এখানেই ওর আপওি… ছোটবেলার থেকেইও অন্য দশটা বাচ্চার থেকে আলাদা.. খুব নরম মনেরএবং মানবিক গুনাবলীর অধিকারী…অন্যায় সহ্য করতেপারতো না..একদিন দারোয়ানের ছেলের সাথে বসে খেয়েছিলো বলে বাবা ওকে মেরেছিলো..ও প্রতিবাদ করেছে..ও কি মানুষ না? ওর এই প্রতিবাদী স্বভাবের কারনে বাবা ওকে পছন্দ করতেন না।এ নিয়ে প্রায়ই ঝামেলা হতো।ওর বাবা ছিলেন ভীষন রাগী এবং দাম্ভিক।মাকেও বিভিন্ন ভাবে নীচুকরতেন..এ সব নিয়েও সংসারে অশান্তি চলতোই! মার জন্য খুব কষ্ট হতো..এ সব দেখে বিওশালী জীবনের অন্ত:শার শূন্য চিত্র অল্প বয়সেই বুঝে গিয়েছিলো।আর তাই পড়াশুনা করে অন্যরকম একটা জীবনের স্বপ্ন দেখতো সে।ভাল ছাত্র ছিলো .. কলেজ শেষ করে ..মেডিকেলে ভর্তি হলো।বাবা বড় ভাইয়ের মত তাকেও বাইরে পাঠাতে চেয়েছিলে..কিন্তু সে কিছুতেই যাবে না..এনিয়ে বাবা ভীষন বিরক্ত..শেষ পর্যন্ত অনিন্দ্য হস্টেলে চলে গেল! পড়াশুনার বাইরে ছাত্র রাজনীতিতে জড়ালো..কিন্তুএখানে সেই একই অবস্হা ..সবই স্বার্থ .. এর বাইরে মানুষের জন্য কিছু করার কোন ইচ্ছে কারো নেই! নেই সমাজ বদলের কোন প্রক্রিয়া..ছেড়ে দিলো রাজনীতি। পড়াশুনায় মনোযোগী হলো…স্কলারশীপ পেয়ে গেলো। সময় গড়িয়ে গেল নিজস্ব ধারায়..সমাজ কল্যাণমূলক কাজের সাথে সব সময় জড়িয়ে থাকতো। ভাল রেজাল্ট নিয়ে পাশ করে..ইন্টারশীপ শেষ করে চাকরি পেল …ঢাকার বাইরে।পরিবার থেকে আবারবাধা ..একরোখা অনিন্দ্য শুনলো না চলে গেল গ্রামে।এরই মধ্যে সেতু নামের মেয়েটিকে ভালবেসে বিয়ে করলো…পরিবার থেকে কেউ মানলো না…মা চোখের জল ফেললেন…কারন তার মতামতের কোন মূল্য নেই! কিছুদিন ভাল চললো..হঠাৎ করে মা হার্ট এ্যাটাকে চলে গেলেন..অনিন্দ্য জীবনের সব চাইতে বড় আঘাত পেলো।
বাবা তাও একবিন্দুও টললেন না…ঐ জীবনের সাথে তার শেষ সুতোটাও মনে হয় ছিড়ে গেল! এর মধ্যে সেতু মা হলো…মেয়ে …নাম রাখলো টুই! সেতু আর গ্রামে থাকতে চাইলো না… শ্বশরবাড়ীর সম্পদ সে চাইছে…এ নিয়েই তুমুল ঝগড়া…একরোখা,এক আদর্শ নিয়ে চলা অনিন্দ্য মানলো না।শেষ পর্যন্ত বিচ্ছেদ ..টুইকে নিয়ে কিছুই করলোনা..কারন জানে মাকে দরকার টুইর…ভিতরে প্রবল ভাঙচুর ..কিন্তু বাইরে শান্ত রইলো।ভোগবাদী সময়ের কাছে অনেকেই হার মানে..কিন্তু ও হার মানলো না।জীবন মানুষকে নিয়ে অনেক খেলা খেলে…মানুষ শুধু পুতুলের মত তার অংশ হয়ে যায়। এরপর দেখা হলো পার্বত্য অন্চলের মিশনারী হাসপাতালের ডক্টর হেনরীর সাথে…বহু বছরআগে নামী একটা এনজিও-র মাধম্যে প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে চিকিৎসা দিতে এদেশে আসা …তারপর আর ফিরে যাননি…অনিন্দ্যর আদর্শ আর তৃনমূল মানুষের প্রতি ভালবাসা দেখে তাকে এ হাসপাতালে জয়েন করতে বললেন।
অনিন্দ্য রাজী হয়ে গেল…মনে হলো এই মানুষ গুলোর জন্য এবার হয়তো কিছু করতে পারবে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠি যে কি পরিমান অবহেলিত তা কাছে না গেলে বোঝা যায় না… সেই থেকে সে এখানে।মাঝে মাঝে ভারি একা লাগে…প্রায়শ মনে হয় সে একজন পরাজিত মানুষ।টুইয়ের জন্য বুকের ভিতরটা পোড়ে…ওর মুখে বাবা ডাকটা শোনার জন্য মনটা আকুল হয়।মাঝে মাঝে ঢাকায় গিয়ে ওর সাথেদেখা করে… কিন্তু অল্প সময়ের জন্য..মনটা ভরে না। এ সমাজ, এ সংসার বাবাদের কেমন যেন এক অদৃশ্য কঠোরতায় আটকে রেখেছে..বাবারাও কষ্ট পায়,তারা সন্তানকে জন্ম দেয় না।কিন্তু যে রক্তের বন্ধন,যে আত্মার টান তা কিভাবে ভুলবে! সব বাবা সমান নয়..নিজের বাবাকে সে কখনো অসম্মান করেনি। বাবাই তাকে দম্ভের কারনে দুরে ঠেলে দিয়েছে।ওর ভিতরে যখন টুইয়ের জন্য প্রগাঢ় সেন্হ জেগে উঠে তখন সে নি:শব্দে কাঁদে ..একজন বাবার ভেঙে যাওয়া হৃদয়ের স্বাক্ষী হয়ে থাকে শুধু এই নিবিড় প্রকৃতি…সংসারে এক অজানা কারনে বাবাদের কষ্টের জায়গাটা চাপা পড়ে থাকে! তারপরও সে আবার ফিরে আসে নিজের দায়িত্বে নিজের লক্ষ্যে… এই একাকিত্ব এই কষ্টকে সরিয়ে রেখে সামনে আগায়… এটাই তার চরিত্রের দৃঢ়তা।

Written by: Fouzia Yasmin Eva
Fouzia Yasmin Eva has completed her graduation from the Department of History, University of Dhaka. She is one of the valuable content contributors of Pensive Stories.